সারা বিশ্বে পুরুষদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পিছিয়ে নেই রাজনীতিতেও। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখা গেল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানে। রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বে বেশ পিছিয়ে দেশটি। যে কয়েকজন রয়েছেন তারাও প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে দেশটির কয়েকজন নারী রাজনীতিকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। সাতোকো কিশিমোতো (৪৮)। ২০২২ সালের জুনে জাপানের টোকিওর সুগিনামির জেলার প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন। পূর্বে কোনো রাজনৈতিক পদে থাকার অভিজ্ঞতা না থাকা সাতোকো টোকিওর ২৩টি প্রধান জেলার মাত্র তিনজন মহিলা মেয়রের একজন। প্রাক্তন পরিবেশ কর্মী এবং গণতন্ত্র বিষয়ক আইনজীবী এই নারী মাত্র ২০০ ভোটে রক্ষণশীল ক্ষমতাসীনকে পরাজিত করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি দেশের পুরুষশাসিত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। মিসেস কিশিমোতো বলেন, ৭৫ বছর ধরে জাপানে নারীদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় একই রয়ে গেছে। এটা আশ্চর্যজনক। রাজনীতিতে নারীদের এই কম প্রতিনিধিত্বকে আমাদের জাতীয় সংকট হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, একজন তরুণী হিসাবে মেয়র পদে দায়িত্বের প্রথম কয়েক মাসের যাত্রাটি খুব কঠিন ছিল আমার জন্য। যেহেতু আমি আমলাতন্ত্রের বা রাজনীতিবিদ ছিলাম না। তার নিজের জেলায়, মেয়রের চেয়ে নিচের বেশিরভাগ সিনিয়র রাজনৈতিক পদে পুরুষরা রয়েছেন। লিঙ্গ সমতার মতো সমস্যাটি একচ্ছত্র পুরুষ রাজনীতির জন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এটি হতাশাজনক। আমি সত্যিই নীতি নিয়ে বিতর্ক করতে চাই। কিন্তু কাউন্সিলে সমালোচনা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য এতে অনেক সময় নষ্ট হয়।
মিসেস কিশিমোতোর মতে, প্রথাগত সামাজিক নিয়ম যা এখনো নারীদের পরিবারের প্রতি যতœ এবং গৃহস্থালির কাজ করার প্রত্যাশা করে। তাদের পক্ষে রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গঠন করা খুবই কঠিন এবং হয়রানির। তিনি বলেন, জাপানে লিঙ্গ বৈষম্যের অবস্থার জন্য এলডিপি সরকার দায়ী। তারা বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়নি। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। যা খুবই বিব্রতকর। তিনি বলেন, সব প্রতিকূলতার পরেও আমি আশাবাদী যে, একদিন জাপানে একজন নারী নেত্রী আসবেন। আমি জানি না এটা অদূর ভবিষ্যতে হবে কিনা। তবে আমি আশাবাদী। আমরা আর খারাপ হতে পারব না। একমাত্র উপায় হলো এগিয়ে এবং এগিয়ে যাওয়া।
টোমোমি হিগাশি টোকিওর মাচিদা জেলার স্থানীয় কাউন্সিল সদস্য এবং সম্প্রতি দ্বিতীয় মেয়াদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, শারীরিক হয়রানির কারণে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম। এমনকি নির্বাচনি প্রচারণার প্রথম দিনগুলোতে আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করা হয়েছিল। তখনই আমি সত্যিই পুরুষশাসিত সমাজ অনুভব করেছি। এটি আমাকে লড়াইয়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে সাহস জুগিয়েছে। জেগে ওঠার আহ্বান ছিল। তিনি অন্যান্য মহিলা স্থানীয় রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং গবেষকদের একটি দলে যোগদান করেছেন যারা রাজনীতিতে নারীদের জন্য হয়রানি পরামর্শ কেন্দ্র নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন। তারা আশা করছেন যে, তাদের গোপনীয় অনলাইন সেশনগুলো নারীদের রাজনীতিতে আসার জন্য একটি নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য প্রদানে সহায়তা করবে।
মারি হামাদা নামের একজন রাজনৈতিক গবেষক জানান, অনেক জরিপ নারী রাজনীতিবিদদের জন্য হয়রানির ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে, তবে এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া খুব কঠিন কারণ বেশিরভাগ নারীরাই কথা বলতে অনিচ্ছুক।
ওয়েবসাইটটির অন্য প্রতিষ্ঠাতা মানা তামুরা, যিনি ২০২২ সালে স্থানীয় অফিসের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তিনি বলেন, তাকে ৩ বছরের ছেলেকে প্রচারে নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
জাপানের কিয়োডো নিউজ এজেন্সির একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারী রাজনীতিবিদ এবং নেতারা তাদের পুরুষ প্রতিপক্ষের তুলনায় লিঙ্গ পক্ষপাত ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এমনকি আরও বেশি নারীকে রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করতে। সরকার যথেষ্ট কাজ করছে না। জাপানের বর্তমান ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) মাত্র পাঁচজন মহিলা আইনপ্রণেতাকে তার বোর্ড সভায় পর্যবেক্ষক হিসাবে যোগদান করার অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। সেইসঙ্গে শর্ত ছিল তারা যেন সভা চলাকালীন নীরব থাকে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, লিঙ্গ সমতায় জাপান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১১৬তম স্থানে রয়েছে। জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সকারী হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এমনকি দেশটিতে কখনও একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন না। বর্তমান ১৯ জনের মন্ত্রিসভায়ও মাত্র দুজন মহিলা রয়েছেন। জাপানের মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিরোকাজু মাতসুনো বলেন, জাপানে নারী রাজনীতি বেশ কঠিন এবং এটি একটি সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।