বুধবার , ৫ এপ্রিল ২০২৩ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. উপ-সম্পাদকীয়
  5. কৃষি ও প্রকৃতি
  6. ক্যাম্পাস
  7. খেলাধুলা
  8. চাকরি
  9. জাতীয়
  10. জীবনযাপন
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দেশগ্রাম
  13. দেশজুড়ে
  14. ধর্ম
  15. নারী ও শিশু

মোদির ভারতে তৈরি হচ্ছে ‘অন্য’ ইতিহাস

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
এপ্রিল ৫, ২০২৩ ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

শুধু মোগল নয়, শুধু উত্তর প্রদেশেও নয়, সারা দেশেই ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইতিহাস বই থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে ‘ঔপনিবেশিক’ ভাবনায় রচিত ‘ভুল’ ইতিহাস, যা দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় ঐতিহ্য ও গরিমার পরিবর্তে ‘ইংরেজিয়ানার জয়গান’ গেয়েছে। সংঘ পরিবার, বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সরকারের দৃষ্টিতে এই নবপ্রচেষ্টা ‘নতুন, সঠিক, ভারতীয় ও হিন্দু ইতিহাস’।

সেই ইতিহাস থেকে কেবল মোগলদের কীর্তিকলাপই বাদ দেওয়া হয়নি, বাদ পড়েছে গান্ধী-হত্যার এযাবৎ স্বীকৃত ব্যাখ্যা এবং হিন্দুত্ববাদের প্রসারে যা কিছু বাধা বলে শাসককূল মনে করে। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে যে ‘পুনের ব্রাহ্মণ’, বাদ দেওয়া হয়েছে সেই পরিচয়ও। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনদের ‘নিষিদ্ধ’ করার প্রসঙ্গও ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে এখন খুঁজে পাবে না শিক্ষার্থীরা।

পাবে না ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা–সম্পর্কিত বহু তথ্যও। এমনকি গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘রাজধর্ম’ পালন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর পরামর্শও নতুন ইতিহাসে স্থান পায়নি। চলতি শিক্ষাবছর (২০২৩–২৪) থেকে দেশজুড়ে স্কুলপড়ুয়ারা এই নতুন ইতিহাসের জ্ঞান লাভ করবে।

মুছে দেওয়া হয়েছে নাথুরাম গডসের ‘পুনের এক ব্রাহ্মণ’ পরিচয়। পাশাপাশি মুছে দেওয়া হয়েছে এক পত্রিকা সম্পাদকের পরিচয়, দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসে যাঁকে চিত্রিত করা হয়েছিল ‘উগ্রবাদী হিন্দু পত্রিকার সম্পাদক, যিনি গান্ধীজিকে মুসলিম তোষণকারী বলে নিন্দা করেছিলেন’।

গুজরাটে ২০০২ সালে দাঙ্গার সময় মুসলমানদের সম্পত্তি ধ্বংস ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নতুন বইয়ে দাঙ্গার অনেক তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে

গুজরাটে ২০০২ সালে দাঙ্গার সময় মুসলমানদের সম্পত্তি ধ্বংস ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নতুন বইয়ে দাঙ্গার অনেক তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে 
ফাইল ছবি রয়টার্স

ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) এ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কোভিডকালে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমানোর সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পরিবর্তনকে এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষ ‘যুক্তিপূর্ণ’ বলে দাবি করেছে। সংস্থার পরিচালক ডি এস সাকলানি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এ বছর নতুন কিছুই করা হয়নি। গত বছর যা কিছু করা হয়েছে, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে তা রূপায়িত হবে।’

সাকলানিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, গান্ধীজির হত্যা ও সে–সম্পর্কিত বহু তথ্য যে বাদ দেওয়া হলো, গত বছর সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইয়ে এসব ছিল না। এ বছরের নতুন পাঠ্যপুস্তক থেকে তা সরাসরি বাদ দেওয়া হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘হতে পারে কিছু তথ্য তখন দৃষ্টিগোচর হয়নি। সব বদলই গত বছর করা হয়েছে।’

সেই বদলের তালিকায় শুধু ইতিহাসের বই-ই নয়, বদল ঘটানো হয়েছে নাগরিক বিজ্ঞান বা ‘সিভিকস’, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিন্দি পাঠ্যক্রমেও। হিন্দি সাহিত্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু কবিতা ও অনুচ্ছেদ, যা নতুন ভারতের উপযুক্ত নয়। নাগরিক বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার আধিপত্য’ ও ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’–এর মতো বিষয়। বদলে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাজনীতি’ অধ্যায়। পাল্টানো হয়েছে ‘জনপ্রিয় আন্দোলনের উত্থান’ ও ‘এক পক্ষের আধিপত্যের যুগ’ নামের দুটি অধ্যায়ও।

দশম ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বদলে দেওয়া হয়েছে ‘গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য’, ‘জনপ্রিয় সংগ্রাম ও আন্দোলন’, ‘গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ’ এবং ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ অধ্যায়ে। এনসিইআরটির বই দেশের যেসব স্কুলে পড়ানো হয়, সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার পরিচালিত বোর্ড যারা এনসিইআরটির পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি দেয়, সর্বত্রই এসব নতুন তথ্য পড়ানো হবে, যাতে ছাত্রাবস্থাতেই পড়ুয়ারা দেশের ‘প্রকৃত সত্য’ সম্পর্কে জানতে পারে ও ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার বন্ধনমুক্ত’ হয়।

মোদি সরকারের সেই চেষ্টাতেই কোপ পড়েছে গান্ধী-হত্যা–সম্পর্কিত ইতিহাসে। মুছে দেওয়া হয়েছে গুজরাট দাঙ্গার যাবতীয় ‘ভুল তথ্য’। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, কীভাবে বিভিন্ন পাঠ্যক্রম থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ও গান্ধী-হত্যা–সম্পর্কিত অংশগুলো। যেমন ‘পাকিস্তান হচ্ছে মুসলমানদের জন্য, ভারতও তেমনি শুধু হিন্দুদের দেশ হওয়া উচিত। এই মতে যাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন কিংবা যাঁরা মনে করতেন, হিন্দুদেরও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা উচিত, গান্ধীজিকে তাঁরা পারতপক্ষে পছন্দ করতেন না।…হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য গান্ধীজির প্রচেষ্টা তাঁকে মারতে হিন্দু উগ্রপন্থীদের প্ররোচিত করেছিল। বেশ কয়েকটা চেষ্টাও হয়েছিল।…গান্ধী হত্যা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়।

যেসব সংগঠন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াচ্ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। আরএসএসের মতো সংগঠন কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।’

পাঠ্যবই থেকে এসব লাইন পুরো ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গেই মুছে দেওয়া হয়েছে নাথুরাম গডসের ‘পুনের এক ব্রাহ্মণ’ পরিচয়। পাশাপাশি মুছে দেওয়া হয়েছে এক পত্রিকা সম্পাদকের পরিচয়, দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসে যাঁকে চিত্রিত করা হয়েছিল ‘উগ্রবাদী হিন্দু পত্রিকার সম্পাদক, যিনি গান্ধীজিকে মুসলিম তোষণকারী বলে নিন্দা করেছিলেন’।

বড় কোপ পড়েছে মোগল ও মুসলমানদের শাসন যুগের ওপর। মামলুক, তুঘলক, খিলজি, লোদিদের মতো সুলতান যুগ ও মোগল শাসনের বহু তথ্য বাদ পড়েছে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে। বাবর, হুমায়ুন, শাহজাহান, আকবর, জাহাঙ্গীর বা আওরঙ্গজেবের আমলে যা কিছু ‘উন্নতি’, সব ছেঁটে দেওয়া হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের পাঠ্য থেকে। দ্বাদশ শ্রেণিতে আর পড়ানো হবে না ‘আকবরনামা’ ও ‘বাদশাহনামা’। নতুন ভারতের নতুন ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সুলতান মাহমুদ গজনির ভারত আক্রমণ ও গুজরাটের সোমনাথ মন্দির ভেঙে দেওয়ার অংশ।

গজনির নাম থেকে ‘সুলতান’ যেমন বাদ দেওয়া হয়েছে, তেমনই ‘তিনি বছর বছর ভারত আক্রমণ করতেন’ বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে ‘ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৭ বার এই উপমহাদেশ আক্রমণ করেছিলেন’।

জরুরি অবস্থার ইতিহাসেও কোপ পড়েছে। কোন পরিস্থিতিতে কী কী কারণে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা নতুন বইয়ে নেই। সবচেয়ে বেশি বাদ দেওয়া হয়েছে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা–সম্পর্কিত নানা তথ্য। আগের বইয়ে কীভাবে দাঙ্গা বাধে, তার বর্ণনা ছিল দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। ঘটনাপঞ্জির বিস্তারিত বিবরণ ছিল তাতে।

গুজরাট দাঙ্গার উল্লেখ করে যেখানে লেখা হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ধর্ম ব্যবহারের বিপদ এবং তা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কী বিষফলের জন্ম দিচ্ছে।’ পাশাপাশি বাদ দেওয়া হয়েছে মোদিকে পাশে বসিয়ে তাঁর উদ্দেশে বলা বাজপেয়ীর সেই ‘রাজধর্ম’ পালনের উপদেশ।

ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় থেকেই বিজেপি ভারতীয় ইতিহাস তাঁদের মতো করে বিনির্মাণে তৎপর। প্রধানমন্ত্রী মোদি, সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ অনেকেই নিয়ম করে নতুন ভারতের ‘ঠিক, সত্য ও ভারতীয়’ ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন। সেই লক্ষ্যে এনসিইআরটি ২০১৭ সালে পাঠ্যপুস্তকে প্রথম পরিবর্তন এনেছিল। দ্বিতীয়বার আনা হয় ২০১৯ সালে। এবার হলো কোভিডের দোহাই দিয়ে তৃতীয় দফার ‘ইতিহাসের ভুল সংশোধন’।

সর্বশেষ - সারাদেশ