বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে পরিষ্কার ফেবারিট ছিলো ভারত। টানা ১০টি ম্যাচ দাপটের সঙ্গেহ জয় করে এসে ফাইনাল খেলতে নামার আগে কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, এই ম্যাচে এসে খেই হারিয়ে ফেলবে ভারত; কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটলো। ভারতকে কাঁদিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নিলো অস্ট্রেলিয়া।
ফাইনালের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক বলেছিলেন, স্টেডিয়ামের ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে পারার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। নিজের কথামতো, সেই কাজটিই করতে পেরেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। ১ লাখ ৩০হাজার দর্শকের গগণবিদারী আওয়াজে যখন চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠছিলো, তখন তাদেরকে স্রেফ মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক।
বিরাট কোহলিকে বোল্ড করে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে যে অস্বাভাবিক পিনতন নীরবতা নেমে এসেছিলো, আহমেদাবাদের নীল জনসমূদ্রকে যেভাবে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই প্যাট কামিন্সের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত হয়ে থাকবে। ২০১১ সালে অভিষেক হওয়ার পর অনেক ভালো ভালো স্মৃতি তার ঝুলিতে জমা হয়েছে। কিন্তু নীল জনসমূদ্রকে চুপ করে দেয়ার চেয়ে সেরা কিছু হতে পারে না আর তার।
প্যাট কামিন্সের ব্যাক অফ দ্য লেংথের একটি বল কভারের দিকে খেলতে গিয়ে ব্যাটে লেগে উইকেট ভেঙে দেয় বিরাটের। তিনি তখন ব্যাট করছিলেন ৫৪ রানে। কোহলি আউট হতেই মনে হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার দর্শকের চিৎকার এক মুহূর্তে যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে কেউ শুষে নিয়েছে।
সোমবার এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন কামিন্স। আরও বলেছেন, ‘আমাদেরও সেই গ্যালারির নীরবতা অনুভব করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। মনে হয়েছিল ফাইনালের মঞ্চ বিরাটের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, অন্যদিনের মত ও রোববারেও শতরান করবে; কিন্তু ও ব্যর্থ হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম।’
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইলান থেকে চলতি বছরের বিশ্বকাপ- বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের কাছে মাথাব্যাথার অপর নাম ২৯ বছরের অসি ব্যাটার ট্রাভিস হেড। অধিনায়কের মুখ থেকে শোনা গেছে তার সতীর্থের প্রশংসাও। কামিন্স বলেছেন, ‘হেড অতুলনীয়। ওকে বিশ্বকাপের দলে রাখা হলেও প্রথম একাদশে চোটের কারণে ছিল না। আমাদের কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড এবং প্রধান নির্বাচক জর্জ বেইলির অনেকাংশে ভূমিকা রয়েছে তাকে দলে রাখার পেছনে।’
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বুমোরং হয়েও আসতে পারত। কামিন্স বলেছেন, ‘প্রতিযোগিতার অর্ধেকটা সময় ওর হাত এবং আঙুল ভাঙা ছিল। তাই ওকে দলে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিশেষ ধন্যবাদ মেডিক্যাল টিমকেও, ওকে পারফর্ম করার মঞ্চটা তৈরি করে দেওয়ার জন্য।’ কিন্তু হেড ব্যর্থ হলে সমালোচনার তীরও ধেয়ে আসত কামিন্সের দিকে। ‘বিশ্বকাপের মত এই রকম প্রতিযোগিতা জিততে হলে ঝুঁকি নিতেই হত।’, জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
আঙুল এবং হাত ভাঙা অবস্থাতেও সব যন্ত্রনা উপেক্ষা করে দেশের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছেন হেড। কামিন্স বলেছেন, ‘ওর মত ক্রিকেটারকে আমি দলে চাই। ও হাসি মুখে খেলে প্রতিপক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। ওর জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।’
ভারতে দুর্দান্ত একটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও এই ফরম্যাট ঘিরে আলোচনা চলছে, একে ধরে রাখা হবে কি না, বাদ দেয়া হবে। অর্থ্যাৎ, ওয়ানডে ক্রিকেট বিলুপ্ত হওয়ার পথেই।
প্যাট কামিন্স বিশ্বকাপ নিয়ে আশাবাদী হলেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ভাগ্যাকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। কামিন্সের কথায়, ‘বিশ্বকাপ জয়ের ফলে আমি আবার নতুন করে ৫০ ওভারের ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে গেছি। বিশ্বকাপের মত প্রতিযোগিতায় প্রত্যেক ম্যাচে নতুন কাহিনি লেখা হয়। জোর দিয়ে বলতে পারি, ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ আরও অনেক দিন থাকবে। এই প্রতিযোগিতা প্রত্যেকের হৃদয়েই আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু দ্বি-পাক্ষিক সিরিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অতটা আশাবাদী নই।’
মাঠে খেলেছেন এগারো জন ক্রিকেটার। কিন্তু মাঠের বাইরে থেকে তাদেরকে ভরসা যুগিয়ে গিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের অবদানের কথাও স্বীকার করেছেন কামিন্স। তিনি বলেন, ‘জয়ের পরে পরিবারের পক্ষ থেকে বার্তা পেয়েছি। বাবা জানিয়েছেন, তিনি অনেক দিন খেলা দেখবেন বলে ভোর ৪টার সময় উঠে পড়েছেন, আবার অনেক দিন ভোর ৪টা পর্যন্ত খেলা দেখার পরে ঘুমোতে গেছেন। ফলে পরিবারের লোকেদের আত্মত্যাগও ভোলার নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দলের প্রত্যেকে এই বছরের অনেকটা সময় ঘরের বাইরে কাটিয়েছে; কিন্তু আমাদের সব কষ্ট লাঘব হয়ে গেছে বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্ত উপভোগ করতে পেরে।’
ম্যাচের আগের দিন নিজের অভিজ্ঞতার কথা উঠে কামিন্সের মুখে। ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে হোটেলের ঘর থেকে দেখেছিলেন ভারতীয় সমর্থকেরা দলে দলে স্টেডিয়ামের দিকে চলেছেন। সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘হোটেল থেকে দেখছিলাম নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামের দিকে চলেছেন। ওই জনসমুদ্রের ঢেউ দেখে আপনার মনে হতে বাধ্য, আপনি বোধ হয় কোনও বিশেষ উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। সেই সময়টাতে সত্যিই আমি কিছুটা স্নায়ুর চাপে ভুগছিলাম।’