একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সৈয়দ শওকাতুল ইসলাম ওরফে পাতলা ডাক্তারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন।
জবানবন্দি ও জেরা শেষে পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৮ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বৃহস্পতিবার ( ৭ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম।
বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নী। তিনি এদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মুখলেসুর রহমান বাদল। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট গাজী এমএইচ তামিম।
সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শওকতুল ইসলামসহ ১০-১৫ জন সশস্ত্র রাজাকার এবং আনুমানিক ১০০-১৫০ জন পাকিস্তানি আর্মি ফটিকছড়ির ১৪ নম্বর নানুপর ইউনিয়নের নানুপুর সৈয়দপাড়া গ্রাম এবং মাইজভান্ডার আমতলী গ্রামে অভিযান চালায়।
এসময় তিনজন পুরুষ ও দুজন নারীকে ধরে নিয়ে যান তারা। এদের মধ্যে দুজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাদের চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ওই সময় আমি মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চলে যাই। এরপর আমি জানতে পেরেছি ১৫ দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয় মির্জা মোহাম্মদ আকবরকে। আর দুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, আটক নারীদের প্রায় এক মাস চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আটক রেখে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে।
প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নী আরো বলেন, বর্তমানে মামলার একমাত্র আসামি শওকাতুল ইসলাম জামিনে রয়েছেন। এর আগে মামলায় আসামি ছিলেন দুজন। এরমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ৮ মার্চ মারা যান মামলার অপর আসামি সৈয়দ ওমর ফারুক ওরফে সৈয়দ মো. ফারুক হায়াত।
এর আগে ১১ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শওকাতুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা ছয়টি অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেন। তারই ধারাবাহিকতায় অভিযোগ গঠন করে বিচারের কাজ শুরু করে ওপেনিং স্টেটমেন্ট উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত।
২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর শওকাতুল ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ওইদিন ধানমন্ডিতে তদন্ত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক এ তথ্য জানান। এটি তদন্ত সংস্থার ৮৬তম প্রতিবেদন।
২০১৯ সালের ৬ মার্চ আসামি শওকাতুলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এরপর তিন বছর আট মাস ২০ দিন অনুসন্ধান শেষে ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রস্তুত করার পর প্রসিকিউশনের কাছে তা দাখিল করা হয়।
আসামির বিরুদ্ধে ১০ হত্যাকাণ্ডসহ তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এরমধ্যে চারজনকে ধর্ষণ, দেড় শতাধিক লোককে আটক-নির্যাতন এবং দুই শতাধিক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ আনা হয়।
তদন্তে জব্দ তালিকাসহ মোট ১৪৪ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়ে আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) দুজন এবং বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ মোট তিনজন মামলাটি তদন্ত করেন।
মামলায় অপরাধ সংঘটনের স্থান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বিভিন্ন এলাকা উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় ১০ জনকে হত্যা, চার নারী ধর্ষণ, আসামির ছোড়া গুলিতে একজন গুলিবিদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেড় শতাধিক লোককে আটক-নির্যাতন এবং প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।