পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন। এ দিনটিকে বাংলাদেশ জাতীয় উৎসব হিসেবে পালন করে। এদিনকে ঘিরে নতুন পোশাক কিনেন সামর্থ্যবানরা। অংশ নেন মঙ্গল শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতাসহ নানা কর্মকাণ্ডে। ‘শুভ নববর্ষ’ শব্দের ব্যবহারে হয় শুভেচ্ছা বিনিময়।
কিন্তু এবারে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ এক সময়ে হওয়ায় পৃথকভাবে বৈশাখের আমেজ কমেছে। আনুষ্ঠানিকতায় স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য পাচ্ছে ঈদ। কিছুটা নিষ্প্রভ হচ্ছে বৈশাখ। কেনাকাটায়ও এর ছাপ পড়েছে। এর ফলে অনেকেই ধারণা করছেন এবার ঈদের ছুটিতে অনেক মানুষ গ্রামে গেছেন তাই গ্রামের বৈশাখ জমজমাট হবে। অন্যদিকে, শহরের বৈশাখ কিছুটা হলেও জৌলুস হারাবে।
এ নিয়ে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা বলছেন, গেল কয়েক বছর ধরেই রমজানে বৈশাখ হওয়ায় এটির আনুষ্ঠানিকতা কমেছে। এবার ঈদের পর হওয়ায় কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা হবে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী নয়। আগামীতে ঈদের অনেক পরে বৈশাখ হবে, যার কারণে তখন হয়তো চিরচেনা রূপে ফিরবে বৈশাখ।
ঈদ এবং বৈশাখ একসঙ্গে হওয়ায় বৈশাখ মলিন হচ্ছে এটা আমি মনে করি না। দুইটার আবেদন দুই রকম। ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব আর বৈশাখ বাঙালির নিজস্ব উৎসব। তবে, কাপড় ব্যবসায়ীদের বৈশাখী বিক্রি কিছুটা কম হবে। — হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন
ব্যাংক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দে গেল কয়েক বছর বৈশাখের সময় কেনাকাটা করেছেন। অনেকে তাকে উপহারও দিয়েছেন। এবার কেনাকাটা করা হয়নি। কেউ উপহারও দেয়নি। অবশ্য, সরকার বৈশাখী বোনাস দিয়েছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদ রোজা একটা কারণ তো বটেই। দু’টো উৎসব বাঙালি এক করে দেখতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। সমাজের বড় একটা অংশ অবশ্য এটাকে আর নিজেদের উৎসব ভাবতে চায় না। তাছাড়া এ ঈদটা সারা মাসজুড়ে যে প্রস্তুতি নিয়ে আসে, তাতে করে বৈশাখের আবেদন কিছুটা কমে থাকতে পারে। যেমন ধরেন, ছুটিতে যাওয়ার আগে অফিসে অনেকেই ঈদ মোবারক বলেছেন। কিন্তু কেউ শুভ নববর্ষ বলেননি। এটা হয়তো এতটা হতো না, যদি দুটো উৎসব একসঙ্গে না হতো।’
বৈশাখ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাবনা-ছবি জাগো নিউজ
তিনি বলেন, ‘ছুটি আর দু’টো উৎসব ঘিরে লম্বা একটা উপলক্ষ হওয়ার মতো যথেষ্ট উপকরণ ছিল। কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে। সেই আমেজটা দেখতে পাচ্ছি না। আরেকটা বড় কারণ অবশ্য এ লম্বা ছুটিতে মানুষ গ্রামমুখী। ঢাকা অনেকটা খালি হয়ে যাওয়াতে প্রভাবটা পড়তে পারে। ঢাকার বাইরে ঠিক কীভাবে উদযাপিত হচ্ছে বা উদযাপনের প্রস্তুতি কেমন, সেই বিষয়টাতে আমার তেমন ধারণা নেই।’
এ নিয়ে সাংবাদিক উম্মুল ওয়ারা সুইটি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈদে মলিন হয়ে যাচ্ছে বৈশাখ, এমনটি নয়। মানুষ যেহেতু দুটি উৎসবে ছুটিতে গ্রামে গেছে। এবার গ্রামে হবে বৈশাখ। দুটি উৎসবে এক হয়ে অন্যরকম আনন্দ হবে। তবে বৈশাখ অন্যান্যবারের বৈশিষ্ট্য হারাবে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক উৎসবটা এবার কম হবে। টিভি-মিডিয়ায় অনুষ্ঠানও কম হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাদিয়া ফাতাহ বলেন, উৎসবমুখর বাঙালি যে কোনো উৎসবেই মাতোয়ারা। আর গ্রামের পহেলা বৈশাখ মানেই তো ‘বৈশাখী মেলা’। যেহেতু এবার ঈদের ছুটিতে মানুষ গ্রামে ফিরছে তাই মনে হচ্ছে গ্রামের বৈশাখ জাঁকালো হবে। অন্যদিকে, শহরের বৈশাখ কিছুটা জৌলুস তো হারাবেই।
এ নিয়ে ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের স্বত্বাধিকারী শাহীন আহম্মেদ বলেন, ‘গেল কয়েক বছর ধরেই বৈশাখ রমজানের মধ্যে পড়ছে। যার কারণে বৈশাখ ওইভাবে উদযাপিত হচ্ছে না। এবার যেহেতু বৈশাখ ঈদের পর পর হচ্ছে, আগের মতো বড় করে উদযাপিত না হলেও কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকবে। আমরা বৈশাখ নিয়ে খুব বেশি কাজ করেছি, তা নয়। তবে ঈদের পণ্যের মধ্যেই কিছুটাই বৈশাখী লুক দিয়েছি। কিছু কিছু বৈশাখের পোশাকও করেছি। তবে সাধারণত ঈদে যা বিক্রি হয়, তেমনই হয়েছে। বৈশাখের জন্য বাড়তি বিক্রি হয়েছে তা না। গত কয়েক বছর আমরা বৈশাখের জন্য আলাদা পরিকল্পনাই করছি না। আগামী বছর যেহেতু ঈদের অনেক পরে হবে বৈশাখ, তখন হয়তো সেটা নিয়ে পৃথক পরিকল্পনা করবো।’
দুইটা উৎসবই অনেক বড় উৎসব। ঈদ যেমন সারা বছরের বড় উৎসব। দেশীয় পোশাকের ক্ষেত্রে বৈশাখও ঠিক বড় উৎসব। দুইটা উৎসব যখন একসঙ্গে হয়ে যায়, তখন তো আলাদা করা মুশকিল। আমরা ঈদ ও বৈশাখ দুটাকে মাথায় রেখেই ডিজাইন করেছি। এটা তো খুব স্বাভাবিক- দুটো উৎসব কাছাকাছি থাকলে একটা কম গুরুত্ব পাবে।— ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ
আরেক ফ্যাশন হাউস সাদাকালোর স্বত্বাধিকারী আজহারুল হক আজাদ বলেন, ‘দুইটা উৎসবই অনেক বড় উৎসব। ঈদ যেমন সারা বছরের বড় উৎসব। দেশীয় পোশাকের ক্ষেত্রে বৈশাখও ঠিক বড় উৎসব। দুইটা উৎসব যখন একসঙ্গে হয়ে যায়, তখন তো আলাদা করা মুশকিল। আমরা যারা কাজ করি, তারা ঈদ ও বৈশাখ দুটাকে মাথায় রেখেই ডিজাইন করেছি। এটা তো খুব স্বাভাবিক- দুটো উৎসব কাছাকাছি থাকলে একটা উৎসব কম গুরুত্ব পাবে।’
গ্রামীণ মেলার চিরচেনা নাগরদোলা-ফাইল ছবি
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘ঈদ এবং বৈশাখ একসঙ্গে হওয়ায় বৈশাখ মলিন হয়েছে এটা আমি মনে করি না। দুইটার আবেদন দুই রকম। ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এটা এক রকমের। বৈশাখ বাঙালির নিজস্ব উৎসব এটার আবেদন ভিন্ন। তবে, কাপড় ব্যবসায়ীদের বৈশাখী বিক্রি কিছুটা কম হবে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মানুষ এবার বৈশাখী কেনাকাটা কম করেছেন বলে মনে হয়।’
প্রতিবারের মতো এবারও পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় আর্কাইভ ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, বিসিক ও ছায়ানট নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং বাংলা একাডেমি ও বিসিক ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করবে।
বাংলা নববর্ষের প্রথমদিনে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রত্নস্থানগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনায় জাঁকালোভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হবে।
বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে। অভিজাত হোটেল ও ক্লাবগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা এবং ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন করবে।